মুসলিম ভাইবোনদের প্রতি খোলা চিঠি

প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোনেরা, মুসলিম জাতির জন্য আশির্বাদ ও বছরের আধ্যাত্মিক একটি উৎসব হিসেবে কুরবানী ঈদ আমাদের দ্বারপ্রান্তে। মক্কার পবিত্র মাটিতে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান পবিত্র হজ্জ্ব পালনের পরপরই আমাদের দেশে এই উৎসব পালিত হয়। আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবেরা একসাথে নামাজ আদায় করে, উপহার বিনিময় করে এবং ঈদের বিশেষ খাবার উপভোগ করে। এ বছরের এই বিশেষ দিনটি উদ্‌যাপনের প্রাক্কালে আমরা আপনাদের খোলা মন ও হৃদয় নিয়ে দিনটি পালনের কিছু দিক পুনঃবিবেচনা করার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর উপাখ্যান

পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে নবী ইব্রাহিম (আ.) একাধিকবার স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েছেন যে আল্লাহ্‌ তাঁকে তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে উৎসর্গ (জবেহ্‌) করতে আদেশ করছেন।ইব্রাহিম (আ.) যখন প্রায় তাঁর পুত্রের জীবনের ইতি ঘটাতে উদ্যত, ঠিক সে সময় আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় অলৌকিকভাবে তাঁর পুত্রের পরিবর্তে একটি দুম্বা উৎসর্গিত হয় এবং তাঁর পুত্রের জীবন রক্ষা পায়। কুরবানী ঈদকে আমরা আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় ইব্রাহিম (আঃ)-এর নিজ প্রাণপ্রিয় পুত্রের বিসর্জনদানের বিষয়টি আল্লাহ্‌র প্রতি তাঁর অসীম আনুগত্যের প্রতীকী দিন হিসেবে স্মরণ ও পালন করি। আজ এই দিনে লক্ষ লক্ষ প্রাণীর কুরবানী ইব্রাহিম (আঃ)-এর মহান ত্যাগের প্রতীক হিসেবেই ধরা হয়।

কুরবানী, সেকাল ও একাল

কুরআনে প্রাণী কুরবানী সম্পর্কে বর্নিত আছে যে, “তাদের মাংস বা রক্ত আল্লাহ্‌র কাছে পৌঁছাবে না বরং যা তাঁর কাছে পৌঁছাবে তা হলো তোমাদের আনুগত্য” (কুরআন ২২ঃ৩৭)। প্রাণী কুরবানী ইসলামের মূল আধ্যাত্মিক সত্যের অংশ নয় এবং আল্লাহ্‌র ইচ্ছার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য আরও অনেক দানশীল পথ রয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশে হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর সময়কার মরুভূমির জনগোষ্ঠির মত গোশত তেমন দুর্লভ মূল্যবান সম্পদ নয়। বর্তমানে আমরা দরিদ্র অভাবীদের সাহায্য করার জন্য প্রাণী কুরবানী দেবার টাকা আরও কার্যকরী খাতে ব্যয় করতে পারি। যেমন, অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী ও আরও উপকারী উদ্দেশ্যে। সেই অর্থ বা টাকা ঢাকা বা অন্য বড় শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল শিশুদের অবস্থার উন্নয়নে ব্যবহার করতে পারি। অথবা যে সব স্থানে চিকিৎসা সেবা এখনও পৌঁছেনি, সে সব স্থানে হাসপাতাল নিমার্ণের জন্য সেই টাকা ব্যয় করা যেতে পারে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সংস্থা সমাজের সুবিধাবঞ্চিত অংশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। একটি সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তাদের আর্থিক সহযোগিতার আশু প্রয়োজন। এরকম বহু দাতা এবং বেসরকারী সংস্থা মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীও গ্রহণ করে যা আপনাদের খুব প্রিয় এবং আত্মত্যাগের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আপনারা পরিবর্তে অর্থও দান করতে পারেন। প্রাণী উৎসর্গের পরিবর্তে এই দানের অভিপ্রায়ও ইসলাম ও কুরবানী ঈদের উদ্দেশ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ।

goats

প্রাণী ও ইসলাম

মুসলমানদের জন্য কুরবানী ঈদ আনন্দের একটি পর্ব হলেও আল্লাহ্‌র প্রাণীদের জন্য এটা সুখের সময় নয়। এই উৎসবে বহু ছাগল, গরু ও অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণীর জীবনের ইতি ঘটে। যে দেশে মানুষই হৃদয়বিদারক অবস্থায় বসবাস করছে, সে দেশের প্রাণীদের দুর্দশার কথা চিন্তা করা কঠিন। কিন্তু আমরা কিছু সময়ের জন্য আপনাদের এটাই বিবেচনা করার অনুরোধ করছি যে কুরবানী ঈদে উৎসর্গ হবার জন্য যে সমস্ত উট, ভেড়া, ছাগল ও গরু রাখা হয় তারা কতোটা অসহায়। সর্বোপরি, আমরা জানি যে মহানবী মোহাম্মদ (স.) প্রানীদের উপর দয়ার বাণী প্রচার করে গেছেন। তিনি “সমগ্র সৃষ্টির প্রতি করুণা” (কুরআন ২১ঃ১০৭) প্রদানের জন্যই প্রেরিত হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে কুরআন খোলাখুলিভাবে নির্দেশ করে যে, প্রাণীরা আমাদের মতই অনুভবক্ষম; অতএব এটা আধুনিক প্রাণী অধিকার আন্দোলনের মৌলিক মতবাদকেই ধারন করে- “পৃথিবীতে তারা শুধু প্রাণীই নয়, পাখায় ভর করে উড়ে বেড়ানো শুধু পাখিই নয়, তার সাথে তারা আমাদের মতই এক একটি গোষ্ঠী” (কুরআন ৬ঃ৩৮)।

কুরবানী হওয়ার আগে বাংলাদেশে কুরবানীর বহু প্রাণী বহুদূর পথ পায়ে হেঁটে আসে- প্রায়শই একসাথে কয়েকদিন ধরে ভারতের মত দূরবর্তী দেশ থেকে অথবা অপর্যাপ্ত স্থান, খাদ্য, পানি এবং চিকিৎসা সেবা ছাড়াই ট্রাকে গাদাগাদি করে তাদের আনা হয়। এটা হালালও নয়, মানবিকও নয় এবং করুণা ও দয়ার মত ইসলামী অনুশাসনের সাথেও এর তীব্র বিরোধ রয়েছে। আমাদের এই বাস্তবতা ভুললে চলবে না। সহীহ্‌ আল বুখারীতে উল্লেখ আছে মহানবী মোহাম্মদ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, পরকালে প্রাণীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন পুরস্কৃত হবে কিনা। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “প্রতিটি জীবন্ত প্রানীর প্রতি দয়া প্রদর্শনের জন্য প্রশংসিত পুরস্কার রয়েছে”। সাধারণত কুরবানীর প্রাণীদের পা বাঁধা থাকে এবং তারা প্রায় নড়তেই পারে না। তারা একদল মানুষ দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে যার মধ্যে শিশুরাও রয়েছে। আতঙ্কিত প্রাণীদের বেশ কয়েকজন চেপে ধরে রাখে আর তারপর তীক্ষ্ণ ছুরি তাদের গলা বরাবর চালানো হয়। তারা মুক্ত হওয়ার জন্য সংগ্রাম করে, কিন্তু ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণের ফলে মারা যায়।

করুণার ধর্ম

আমরা অনেকেই টেলিভিশন পর্দায় দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হই কী ভাবে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের আরো অনেক দেশে প্রাণীদের লালন-পালন, বহন এবং পরিশেষে হত্যা করা হয়। এটা আমরা আশা করতে পারি শান্তি এবং দয়া ও করুণার ধর্ম হিসেবে ইসলাম এর চাইতে আরও ভালভাবে প্রাণীদের সাথে আচরণ করবে।

নীচে স্বাক্ষরকারী আমরা শ্রদ্ধার সাথে আপনাদের বিবেচনার জন্য এই লেখা নিবেদন করছি এবং আশা করছি মহানবী মোহাম্মদ (সঃ) মানবতার জন্য করুণা ও দয়ার যে সার্বজনীন মাপকাঠির আলোকবর্তিকা দিয়ে গেছেন, এই লেখা পড়ে তার আলোকে আপনারা প্রাণী কুরবানী চর্চার ব্যাপারে আপনাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে তুলতে পারবেন।

ঈদ মুবারাক!

ফারাহ আকবার, লেখক ও শিক্ষাবিদ
রাইনার এবার্ট, মোরাল ফিলসফার, রাইস ইউনিভার্সিটি
কারিনা জান্নাত, আঞ্চলিক পরিচালক, স্টুডেন্টস্‌ ফর লিবার্টি

যারা স্বাক্ষর করেছেনঃ
আবদুল আফরাদ, আই টি পেশাজীবী
ফারজানা আফরোজ, চাকুরীজীবি
ফাইয়াযউদ্দিন আহমেদ, আইনজীবী
রুবাইয়া আহমেদ, প্রাণী অধিকার কর্মী
মিলন এ আকবর, দোভাষী
আসমা আমিন, সমাজকর্মী
সেবির অনিকেত, ব্যবসায়ী
নিয়াজ আরেফিন, ছাত্র, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি
ড. খুরশিদ বেগ, পদার্থবিদ
ড. মনিকা বেগ, সরকারী কর্মচারী
সাদিয়া চৌধুরী, আইনী সহায়তা সহযোগী
সামিউল আফতাব চৌধুরী, আই টি পেশাজীবী
এহসানুল হক, শিক্ষক, রেড ব্রিক স্কুল
এস. এম. ই. হক, ছাত্র, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
হেমা হেলাল, প্রতিষ্ঠাতা, স্নেহা ফাউন্ডেশান
মোঃ সাজ্জাদ হোসেইন, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ফোবি নাদিয়া হান্টার, মানবাধিকার আইনজীবি
রবিন জেকবস্‌, রিয়েল স্টেইট বিক্রয় প্রতিনিধি
এহতেশামুল কবীর, ছাত্র, লেখক
রেজাউল করিম, ছাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রিসালাত খান, ছাত্র, আমহার্স্ট কলেজ
রিয়াদ খান, ইন্ডাস্ট্রি এমপ্লয়ি
জাহিদ হোসেইন খান, ছাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কিটি খন্দকার, সি এফ ও এবং ভি পি ফাইন্যান্স
মাসুদ আল মামুন, রিলিফ ইন্টারনেশনাল কর্মকর্তা
মেহেদী মাসান, কসাইখানার প্রাক্তন মালিক
মাজহারুল ইসলাম মিনরুল, মিউসিক প্রডিউসার, কম্পোজার
কুমার মুর্শিদ, ছাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এলিজাবেথ নার্গি, উন্নয়ন পরামর্শক
তানভির আহমেদ নাসিরুদ্দিন, ছাত্র, ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন
এ্যান পার্কার, সম্পাদক ও প্রাণী অধিকার আইনবিদ
এ এইচ এম মুস্তাফিজুর রহমান, ছাত্র, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
ফৌজিয়া রহমান, সরকারী অফিসার
প্রোফেসর ড. মিজান রহমান, প্রফেসর, কার্লটন ইউনিভারসিটি
নাসরিন রহমান, অফিস ব্যবস্থাপক
আজমাল সোবহান, পদার্থবিদ
অনিক রুমি, রেডিওলজিস্ট
সাবরিনা তোপা, ছাত্রী, রাইস ইউনিভার্সিটি
সায়মা তোপা, ছাত্রী, রাইস ইউনিভার্সিটি
মোহাম্মাদ ফায়সাল উদ্দিন, ছাত্র, কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটি
ফারজানা ওয়াহিদ, স্কুল শিক্ষক